সর্বশেষ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ২২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

DAILYSYLHET
Fapperman.com DoEscorts

বিদায় চিরবসন্তের আবহাওয়া

সায়েম আহমেদ: অনুপম নিসর্গ বিস্তৃত এক বৈচিত্রময় এলাকা পূর্ব আফ্রিকা। এরমাঝে উন্নতশিরে দন্ডায়মান যথাক্রমে আফ্রিকার সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় উচ্চতম গিরিশৃঙ্গ, মাউন্ট কিলিমানজারো ও মাউন্ট কেনিয়া। বিজ্ঞানের জনপ্রিয় মতবাদ বলে, এ এলাকা থেকেই ৭০ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে আদিম মানুষ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। বর্তমানকালে, এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রভূমি কেনিয়া আর আশেপাশে আছে তানজানিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা আর সোমালিয়া। আঞ্চলিক প্রাণভোমরা নাইরোবি (কেনিয়ার রাজধানী, পূর্ব আফ্রিকার বৃহত্তম ও পুরো সাব-সাহারান আফ্রিকায় তৃতীয় বৃহত্তম নগরী) তে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে দীর্ঘ তিন-বছর-দশ-মাস দায়িত্ব পালন করে আগামীকাল, ০৬/০৯/২০২২, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফেরত যাচ্ছি। দীর্ঘদিন পর নিজ দেশে ফেরার রোমাঞ্চ! তবুও, কী এক তীব্র ব্যাথা যেন প্রিয়তম দেশ আর স্বজনদের কাছে ফেরার আনন্দকেও ম্লান করে দিচ্ছে। এক আবেগপ্রবণ বোকা মানুষ আমি। কেনিয়াকে বিদায় দিয়ে লিখতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৬৩ সালে স্বাধীন হওয়া কেনিয়া একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। আঞ্চলিক হাবের তকমা থাকায় নাইরোবির আছে বিশেষ কূটনৈতিক গুরুত্ব। শুধুমাত্র শতাধিক দেশের কূটনৈতিক মিশনই নয়, এখানে নিউইয়র্ক আর জেনেভার পরে জাতিসংঘের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ সদরদপ্তর অবস্থিত। বিশেষ করে, জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউনেপ এর সচিবালয় এখানে। আরও আছে, বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ আন্তঃর্জাতিক ও উন্নয়ন সংস্থা এবং গণমাধ্যমের পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকান সদর দপ্তর। কাজ শেখা বা করার জন্যে নাইরোবি বহুপাক্ষিক কূটনীতির অন্য যেকোন জায়গার চেয়ে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের সাথে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার সুযোগ এখানে আছে। একজন পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে অনেক কিছু দেখার ও শোনার সুযোগ হয়েছে। তবে, পেশাগত কাজ ছাপিয়ে অনেক অনেক বেশি ভালো লেগেছে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চিরবসন্তের আবহাওয়া, ‘হাকুনা মাটাটা’ বা জীবনকে সহজভাবে নেয়ায় মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, জীববৈচিত্র‍্য আর বিদেশিবান্ধব জনগণ।

সমৃদ্ধ প্রকৃতি, পরিবেশ আর প্রাণী অভয়াশ্রমের পঞ্চাশটি ন্যাশনাল পার্ক, পূর্ব আফ্রিকার বিখ্যাত বিগ ফাইভ (সিংহ, হাতি, মহিষ, রাইনো আর লেপার্ড), দেশের অধিকাংশ স্থানেই বছরজুড়ে আরামদায়ক ১৫-২৫ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রা, নিরক্ষরেখার আকর্ষণ, দিগন্তপ্রসারী সাভানা, সাদা বালুর সমুদ্রতট, মরু অঞ্চল, পর্যটকবান্ধব সমাজ আর সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র‍্যের কারণে কেনিয়া আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ধারাবাহিকভাবে, গত সাত বছর ধরে ‘ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এওয়ার্ড’ কেনিয়াকে বিশ্বের শীর্ষ সাফারি গন্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

কেনিয়া আর তানজানিয়ার সীমান্তে বিশ্বের সবচে বড় প্রাণী অভিবাসন বা ‘দি গ্রেট ওয়াইল্ডার বিস্ট মাইগ্রেসন’ ঘটে। ভূতাত্ত্বিক বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন ৬৫০০ কিঃমিঃ দৈর্ঘ্য এবং ৬০ কিঃমিঃ প্রস্থের ‘দি গ্রেট রিফট ভ্যালি’ কেনিয়ার বুক চিরে বয়ে গেছে। কেনিয়া শুধুমাত্র পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বাদু পানির জলাভূমি ‘লেক ভিক্টরিয়া’ এর একাংশই পায়নি, এখানে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম মরু লেক ‘লেক টুরকানা’। নিসর্গপ্রিয় পরিবার আমরা পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণীবৈচিত্র দেখতে সারা কেনিয়ায় ছুটে বেড়িয়েছি। কখনও, ভ্রমণের এ পথে যতদূর চোখ যায় গলফ কোর্সের মতো মৃদু উঁচু-নিচু সাভানা, প্রাণীদের বিচরণ, দূরে ছড়ানো-ছিটানো গাছ যা জিরাফ সমান মাপে ছেঁটে রেখেছে, দিগন্তের অস্তাচলে ডুবোডুবো লাল সূর্য। গোধুলীলগ্নে এই অপার্থিব সৌন্দর্যে গাড়ি চালিয়া যাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবো না।

নাইরোবিস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন কেনিয়ার পাশাপাশি রুয়ান্ডা, তানজানিয়া, উগান্ডা আর সোমালিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরের ধারাবাহিক চেষ্টায় গত জুলাই ২০২২ এ কেনিয়ার সাথে প্রথমবারের মতো ‘বাইলেটারেল কনসালটেসনস’ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো। দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে এ বিরাট এক মাইলফলক। এসময়ে, দু দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমি’র মধ্যে সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়। আরও বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক অগ্রবর্তী আলোচনার পর্যায়ে আছে। কেনিয়া তথা পূর্ব আফ্রিকায় বাংলাদেশের বাণিজ্যের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা আছে। আমাদের তৈরি পোষাক, ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম, প্লাস্টিক সামগ্রী, হালকা মেশিনারিজ, বাইসাইকেল, নির্মাণ সামগ্রী, তৈজসপত্র ইত্যাদির বেশ কদর আছে এখানে। ইতোমধ্যেই, স্কয়ার ফার্মাসিটিকেলস পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার বৃহত্তম জেনেরিক মেডিসিন প্লান্ট গড়ে তুলেছে নাইরোবির উপকণ্ঠে। তানজানিয়া আর উগান্ডার কৃষি ও জলাভূমির প্রতুলতার কারণে আছে ‘ল্যান্ড লিজ ফার্মিং’ এর সম্ভাবনা। আমাদের রপ্তানিকারক, উদ্যোক্তা আর বিনিয়োগকারীরা পূর্ব আফ্রিকার সম্ভাবনাময় বাজারে অধিকতর গুরুত্ব দিতে পারেন।

সাম্প্রতিককালে কেনিয়ায় নিয়মিত রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন দফায় মোট বৎসরাধিককাল আমাকে মিশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। পেশাগত কারণে কেনিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবর্গ, পদস্থ কর্মকর্তা আর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি। পেশাদারী জীবনের মধ্যম-পর্যায়ের একজন কূটনীতিকের কাছে এ অনেক বড়ো পাওয়া। দীর্ঘদিন পরে, মিশনে একজন পেশাদার কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন। বর্তমান মান্যবর রাষ্ট্রদূতের মতো সুদক্ষ ও সজ্জন ব্যক্তির নেতৃত্বে এখানে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বার্থ এক অনন্য উচ্চতায় উত্তরণ করবে প্রত্যাশা করি।

আমি, আমার স্ত্রী ও সন্তানদের সুন্দর ও নিরাপদ ভ্রমণ আর সার্বিক মঙ্গল কামনায় সবার দোয়া চেয়ে বিদায় নিচ্ছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Comments are closed.

নোটিশ : ডেইলি সিলেটে প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি -সম্পাদক

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

২০১১-২০১৭

সম্পাদক ও প্রকাশক: খন্দকার আব্দুর রহিম
নির্বাহী সম্পাদক: মারুফ হাসান
অফিস: ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা, জিন্দাবাজার, সিলেট।
মোবাইল: ০১৭১২ ৮৮৬ ৫০৩
ই-মেইল: dailysylhet@gmail.com

Developed by: